Sunday, July 5, 2015

মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণাকে নিজেরই চিন্তা ও সিদ্ধান্ত বলে মহাভুল করে


রমজান মাস তাকওয়া অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। সুরা বাকারার ২৮৩ নম্বর আয়াত অনুযায়ী রোজার উদ্দেশ্য হল তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন। তাকওয়া শব্দটির অর্থ হল ঢাল নেয়া। মানুষের পার্থিব এই জীবন নানা দিক থেকে প্রকাশ্য ও গোপন শত্রুর নানা ধরনের হামলার হুমকির মুখে রয়েছে। তাই খোদাভীরুকে হতে হয় সব সময়ই শত্রুর বিষয়ে সচেতন ও সংগ্রামী এবং তাকে সংগ্রহ করতে হয় আত্মরক্ষার নানা ধরনের ঢাল।
মানুষের প্রধান অদৃশ্য শত্রু হচ্ছে তার নাফস বা আমিত্বের প্রবৃত্তি। উদ্ধত এই প্রবৃত্তি বিবেক ও খোদা-প্রদত্ত সৎ প্রকৃতির কথা শুনতে চায় না (সুরা শামস-৭), বরং নিজের কোনো কোনো শক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেয় (সুরা রুম-২১)। যেমন, সে ভোগ-লিপ্সার চরিতার্থ করার শক্তি বা ক্রোধ কিংবা এ উভয়কেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিপথে যায়। তাই বলা হয়, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হল তার নাফস বা আমিত্বের প্রবৃত্তি। অন্যদিকে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু ইবলিসও মানুষের ফিতরাত বা খোদার দেয়া প্রকৃতি, আকল ও ওহির পথ থেকে বিচ্যুত করতে সদা-সচেষ্ট থাকে।
শয়তানের অনুসারী রয়েছে মানুষ ও জিনের মধ্যে। শয়তান আল্লাহর খলিফা হতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ মানুষকে নিজের খলিফা বলে ঘোষণা করায় হিংসায় ক্রোধান্ধ হয়ে শয়তান মানুষকে যে কোনোভাবে খেলাফতের পথ থেকে বিচ্যুত করার শপথ নেয়। (সুরা হজর-৩৮, ৩৯; সোয়াদ-৮১)
শয়তান আদমকে সিজদা করার খোদায়ী নির্দেশ অমান্য করেছিল নিজেকে বড় মনে করত বলে। তার হিংসার উৎসটা ছিল এটাই। সে ভেবেছিল আদম মাটির তৈরি আর সে হল আগুনের তৈরি। কিন্তু সে আদমের মধ্যে মহান আল্লাহর ফুঁকে দেয়া রুহের আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা ভাবতেই পারেনি। আশার বিষয় হল শয়তান মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়ার চেয়ে বেশি কিছু করতে পারে না। কারণ মানুষের ওপর তাদের কর্তৃত্ব নেই। (ইব্রাহিম-২২)
তবে সমস্যা হল শয়তানকে খালি চোখে দেখা যায় না; অথচ সে যখন কুমন্ত্রণা দেয় তখন মানুষ সেসবকে নিজেরই চিন্তা ও সিদ্ধান্ত বলে মনে করে। (আরাফ-২৭) ফলে ক্রোধ ও ভোগ-লিপ্সার প্রবৃত্তিকে দিয়ে মানুষ পাপে লিপ্ত হয়। আর পাপ করতে করতে অবস্থা এমন হয় যে তার ভাল-মন্দ বোঝার জ্ঞানও হারিয়ে যায়। (সুরা মুতাফফিন-১৪) বরং এ অবস্থায় সে মন্দকে মনে করে পুণ্য আর ভালোকে মনে করে মন্দ! কিংবা মিথ্যাকে মনে করে সত্য আর সত্যকে মনে করে মিথ্যা! (আরাফ-১৭৯) কারণ, এ অবস্থায় মানুষের চোখ ও কানের ওপর পর্দা পড়ে যায় এবং অন্তরও হয়ে যায় তালাবদ্ধ (বাকারা-৭, জাসিয়া-২৩, তওবা-৮৭, মুনাফিকুন-৩) ।
এভাবে পাপী মানুষ খোদায়ী প্রত্যাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শয়তানের বাণীর দাস হয় ও সত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও বিতর্ক শুরু করে। (আনআম-১২১) মানুষকে এই শোচনীয় দুর্দশা ও শয়তানের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতেই মহান আল্লাহ দিয়েছেন নানা কর্মসূচি। মাহে রমজানের রোজা হল এমনই এক নেয়ামত। এই মাসে শয়তান অন্য সময়ের মত অবাধে তার তৎপরতা চালাতে পারে না। তাই রমজান হচ্ছে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার ও আত্ম-সংশোধনের এক অসাধারণ বা সুবর্ণ সুযোগ।
পুরো এক মাস সংযম চর্চার ফলে রমজানে যে শক্তি অর্জন করে রোজাদার তার বলে মানুষ পুরো বছর জুড়ে শয়তানের কুমন্ত্রণাকে প্রতিহত করতে পারে এবং পরিপূর্ণ তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের পদক্ষেপ নিতে পারে। বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, “হে মানুষ! নিঃসন্দেহে তোমাদের সামনে রয়েছে আল্লাহর বরকতপূর্ণ মাস। এ মাস বরকত, রহমত বা অনুগ্রহ ও ক্ষমার মাস। এ মাস মহান আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ মাস। এ মাসের দিনগুলো সবচেয়ে সেরা দিন, এর রাতগুলো শ্রেষ্ঠ রাত এবং এর ঘণ্টাগুলো শ্রেষ্ঠ ঘণ্টা।"
মুমিন এই মাসে আল্লাহর মেহমান। তাই এ মাসে মুমিনের ঘুম ইবাদতের সমতুল্য ও নিঃশ্বাসগুলো জিকিরের সমতুল্য। এ মাসের এক রাতের ইবাদত অন্য মাসের হাজার রাতের ইবাদতের সমান। এ মাসে কবুল হয় দোয়া। এ মাসে এক আয়াত কুরআন তিলাওয়াত পুরো কুরআন তিলাওয়াতের সাওয়াব এনে দেয়। এ মাসে মুমিনের তওবার অশ্রুতে ধুয়ে মুছে যায় অতীতের গোনাহগুলো। কুরআন নাজিল হওয়ার এ মাসে দেহ ও প্রবৃত্তির ওপর বিজয়ী হয়ে মু’মিন ফিরে আসেন খোদার দিকে। তাই রমজান হচ্ছে মানুষের জন্য আল্লাহর মহাঅনুগ্রহের মাস। এ মাসে মুমিন আল্লাহর মেহমান। তাই তার নিশ্বাস ও ঘুমও সাওয়াবের পরিণত হয়!
তবে যে কোনো উৎসবের অতিথি হতে হলে অতিথিকেও কিছু শর্ত বা নিয়ম মেনে চলতে হয়। আর রমজানের অতিথি হওয়ার শর্ত হল পবিত্র অন্তর ও সৎ ইচ্ছা বা নিয়ত। আল্লাহর কাছেই পবিত্র অন্তরে চাইতে হবে প্রকৃত রোজাদার হওয়ার সাফল্য ও কুরআন তিলাওয়াতের সৌভাগ্য। বিশ্বনবী (সা.)’র মতে সে ব্যক্তি হতভাগা যে ক্ষমার এমন মাসেও আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়।
"হে আমাদের ইলাহ্! আমাদেরকে ঐ সব ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত করবেন না যাদের থেকে আপনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এবং যাদের ভুল-ত্রুটি তাদেরকে আপনার ক্ষমা থেকে বাধাগ্রস্ত করেছে। হে আমাদের ইলাহ্! আপনি আমাদেরকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একমাত্র আপনার দিকে পুরোপুরি রুজু হওয়ার তওফিক দিন। আমাদের অন্তরের চোখগুলোকে আপনার দিকে দৃষ্টি দেয়ার মাধ্যমে আলোকিত করে দিন যাতে করে আমাদের অন্তঃ-চক্ষুর দৃষ্টি আলোর পর্দাগুলো ভেদ করে মহত্ত্বের খনিতে গিয়ে উপনীত হয় এবং আপনার পবিত্র সত্তার সম্মানের সাথে আমাদের আত্মা সংযুক্ত হয়।"

No comments:

Post a Comment