আম্বিয়া খাতুনের কোলজুড়ে এলো ফুটফুটে এক সন্তান। সেই পিচ্চিবেলাতেই খুব চঞ্চল ছিল ছেলেটা। চারদিকে ছুটোছুটি আর দুরন্তপনায় মাতিয়ে রাখত সবাইকে। আর সব শিশু যখন বাবা-মায়ের কাছে খেলনার আবদার করত, তখন সেই ছেলেটার ধ্যানজ্ঞান জুড়ে শুধুই ফুটবল। মাত্র চার বছর বয়সে ছেলেটা ফুটবলপ্রেমে এতটাই মজল যে, এখন মাত্র ৩১ বছর বয়সেই ইংল্যান্ডের তৃণমূল ফুটবলে তাঁর নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে!
নাম তাঁর তাফ রহমান। মৌলভীবাজারের এই কৃতী সন্তান কীভাবে আজ ফুটবলবিশ্বে শুধু বাংলাদেশেরই নয়, এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছেন। আজ যে তাফ রহমান তাঁর কোচিং দক্ষতার জন্য প্রশংসিত, সময়-প্রেক্ষাপট অনুকূলে থাকলে সেই তাফ হয়তো এখন আর্সেন ওয়েঙ্গারের শিষ্য হয়ে থাকতে পারতেন, খেলতেন আর্সেনালের হয়ে! তাফ রহমানের জীবনজুড়ে এমনই সব ক্লাইম্যাক্স-এন্টি ক্লাইম্যাক্স।
ছয় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান তাফ। সেখানেই ধীরে ধীরে তাঁর ফুটবল-প্রতিভার বিচ্ছুরণ হতে লাগল।
মিডলসেক্সের নিজ স্কুল দলে খেলেছেন, খেলেছেন রাজ্য দলের হয়েও। প্রতিভা থাকলে কাউকে দমিয়ে রাখা যায় না। তাফ সুযোগ পেলেন কুইন পার্ক রেঞ্জার্সের বয়সভিত্তিক দলে। সেখান থেকে সোজা গন্তব্য-আর্সেনাল! তাফের বয়স তখন? মাত্র ১১!নেইমারের সঙ্গে তাফ প্রতিভা চেনায় বাড়তি সুনাম আছে ওয়েঙ্গারের। দামি তারকা কেনা নয়, অখ্যাত প্রতিভাদের তারকা বানানোতেই ওস্তাদ তিনি। পাকা জহুরি। তাই আর্সেনালের স্কাউটরা তাফের মধ্যে নিশ্চয়ই সেই সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছিল। ভাবুন তো বাংলাদেশের এক ফুটবলারের সতীর্থের নাম থিয়েরি অঁরি কিংবা অ্যাশলি কোল! তাফ আর্সেনালের একাডেমি ও রিজার্ভ দলের হয়েও খেলেছেন। ছিলেন বৈচিত্র্যময় খেলোয়াড়। খেলেছেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে, এমনকি দুই উইংয়ে। ছিলেন স্ট্রাইকারও।
কিন্তু বিধি বাম। তাফের ফুটবল ক্যারিয়ার বাঁক খেয়ে রাস্তা হারালো। দুর্দান্ত শুরুর পরও হাঁটু এবং হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটের সঙ্গে যুঝতে থাকায় সম্ভাবনাময় ফুটবল ক্যারিয়ারকে আর দীর্ঘায়িত করতে পারলেন না। আর্সেনালের মূল দলে খেলার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিলো না। ক্যারিয়ারের শেষদিকে খেলেছেন বিভিন্ন আধা পেশাদার দলে। তাই বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এক ফুটবলার আর্সেনালের বয়সভিত্তিক দলে খেলেছে-এটা নিয়েই গর্ব করতে হচ্ছে। স্বপ্নটা সত্যি হলে গর্বের মাত্রা আরও বড় হতো সন্দেহ নেই। তবে আর্সেনালের বয়সভিত্তিক দলে খেলাও আমাদের মতো দেশে জন্ম নেওয়া একজন ফুটবলারের জন্য কম কীসে!

তাফ চাইলে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন আধা পেশাদার লিগে খেলে যেতে পারতেন। তাতে অর্থকড়িও মন্দ নয়। আর্সেনালের রিজার্ভ দলে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড়কে লুফে নিতে চাইতো যেকোনো দলই। কিন্তু তাফের ভাবনা ছিল ভিন্ন। তাফ কোচিং পেশার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই যুক্ত হওয়াটা যেনতেনভাবে নয়, তাফের স্বপ্নের ক্যানভাসটা ছিল বিশাল। কঠোর পরিশ্রম করে পেলেন ইউয়েফা ‘এ’ লাইসেন্স ডিগ্রি। যে এমিরেটসে নিজে বয়সভিত্তিক দলের হয়ে খেলেছেন, গানারদের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখেছেন, সেখানেই কোচ হিসেবে ডাক পড়ল তাফের।
আর্সেনালের একাডেমিতে কাজ করলেন দীর্ঘ পাঁচ বছর। ক্লাবের ফুটবল অ্যানালাসিস্ট প্যানেলেরও একজন ছিলেন তাফ। প্রিমিয়ারশিপ ও চ্যাম্পিয়নশিপ দলগুলোর স্কাউট হিসেবে কাজ করেছেন। কোচিং করিয়েছেন বিভিন্ন আধা পেশাদার দলকে। তাফ রহমানকে এক অর্থে ফ্রিল্যান্সার কোচ বলা যায়। কতশত প্রকল্প, তরুণ প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচীতে কাজ করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই!
যখন খেলতেন আর্সেনালের বয়সভিত্তিক দলেকমিউনিটি ফুটবল নিয়ে কাজ করার সুবাদে ২০১৪ সালের সেরা কোচের পুরস্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছেন। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। যদিও এখনো এই ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তাফ এখন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগেরই অন্যতম দল টটেনহামের বয়সভিত্তিক দলের দায়িত্বে আছেন।
তাফ জানালেন, উঠতি খেলোয়াড় হিসেবে যখন ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছিলেন, ক্যারিয়ারের সেই দুরন্ত সময়ে খেলতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের হয়ে। বাফুফের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেছিলেন। বাফুফেও তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর লাল-সবুজের জার্সি গায়ে তোলা হয়নি।
তাফ রহমানের বয়স মোটে ৩১। জাভি-ইনিয়েস্তা-পিরলোরা খেলে যেতে পারলে তাফ কেন খেলতে পারবেন না! মজার ছলেই প্রশ্ন করা হলো, বাফুফে থেকে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে মাঠে নামার সুযোগ পান, তাহলে খেলবেন কিনা। প্রত্যুত্তরে তাফের উত্তর বিস্ময় হয়েই এলো, ‘কেন নয়! দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা—এটা তো আমার স্বপ্ন! গোলক্ষুধা এখনও তো মরেনি! আমার বাংলাদেশি পাসপোর্টও আছে।’ বাফুফে বা বাংলাদেশের কোনো ক্লাব থেকে যদি কোচিংয়ের প্রস্তাব পান, তাহলে রাজি হবেন? এ প্রশ্নের ত্বরিৎ উত্তর দিলেন তাফ, ‘অবশ্যই ভেবে দেখব।’
যাঁরা তরুণ কোচ হতে চান, তাদের জন্য তাফের পরামর্শ, ‘খেলাটা শুধু দেখলেই হবে না, ভালোভাবে অনুধাবনও করতে হবে। সিনিয়র কোচদের সঙ্গে কাজ করে বেশি বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।’
বাংলাদেশের ফুটবল ধীরে ধীরে আবারও জেগে উঠছে যেন। আগের চেয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ বেশি হচ্ছে, ফুটবলারদের দেশের জন্য কিছু করার প্রতিজ্ঞাও ঠিকরে বেরোচ্ছে। জামাল ভুঁইয়া এসেছেন, সামনে রিয়াসাতসহ আরও বেশ কজন প্রবাসী বাংলাদেশীর দেখা পেতে পারে বাংলাদেশ ফুটবল দল। ফুটবলের এমন পুনর্জাগরনের মাহেন্দ্রক্ষণে মাঠে কিংবা ডাগআউটে—একজন তাফ রহমানকে বড্ড বেশি প্রয়োজন বাংলাদেশের!