‘লাইলাতুল কদর’ আরবি শব্দ যা ফারসি ভাষায় শবেকদর বলে পরিচিত। লাইলাতুল অর্থ রাত ও কদর অর্থ মহিমান্বিত বা সর্বোত্তম। ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দের অর্থ মহিমান্বিত রাত বা শ্রেষ্ঠ রাত। রমজান মাসের এই রাতে কোরআন নাজিল হয়েছিল। এই রাত বছরের অন্যান্য রাতের চেয়ে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ। মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘আমি একে নাজিল করেছি শবেকদরে, শবেকদর সম্পর্কে আপনি কি জানেন? শবেকদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ সূরা আল-কদর : ১-৫।
সুতরাং এ রাত বছরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত। পবিত্র কোরআনের বর্ণনায় কদরের রাত হাজার মাস সমান ৮৩.৩৩ বছর বা তার চেয়েও উত্তম। এ সময়টা মানুষের গড় আয়ুর চেয়ে বেশি। শুধু এক রাতের ইবাদত সারা জীবন ইবাদত করার চেয়ে বেশি। এটা এমন রাত যখন সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত মহান আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হতে থাতে।
শবেকদর উম্মতে মুহাম্মদী (সা.)-এর জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে মহান দান। একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের কাছে বনি ইসরাইলের চার নবীর ঘটনা বর্ণনা করলেন যে, তারা প্রত্যেকেই ৮০ বছর পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করেন। এ বর্ণনা শুনে নিজেদের স্বল্প হায়াতের কথা ভেবে সাহাবিরা কিছুটা আফসোস করেন। আর তখনই জিবরাইল (আ.) সূরা কদর নিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে হাজির হন।
এ পবিত্র রাতের মহিমা সম্পর্কে মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন, যারা শবেকদরে রাত জেগে ইবাদত করবে আল্লাহ তাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং রোজ কেয়ামতে তাদের নিরাশ করবেন না। এছাড়াও তিনি এরশাদ করেছেন, লাইলাতুল কদরে ইবাদতকারীর প্রতি আল্লাহতায়ালা দোজখের আগুন হারাম করে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, পুরো রাতকে আল্লাহতায়ালা কদর দিয়েই সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। তোমরা এ রাতেই অধিক ইবাদত-বন্দেগি কর কেন না তা সর্বশ্রেষ্ঠ রাত। আরও এরশাদ হয়েছে, এই পবিত্র রাতটি যারা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়ে দেবে আল্লাহপাক তাদের আমলনামায় এক হাজার বছরের ইবাদতের সওয়াব দান করবেন।
বেহেশতের অভ্যন্তরে তার জন্য বহু গৃহ নির্মাণ করে রাখবেন। পবিত্র কোরআন এবং বহু হাদিসে প্রমাণিত হয়েছে, লাইলাতুল কদরের মহিমান্বিত রাতে আল্লাহর ফেরেশতারা এবং রুহগুলো তারই হুকুমে বান্দাকুলের জন্য সব ধরনের রহমত, বরকত, কল্যাণ ও মঙ্গল বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন, ইবাদত-বন্দেগিরত নেককার বান্দাদের জন্য বিশেষ রহমত ও শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করেন।
কিন্তু শবেকদরের রাত সম্পর্কে সুনিশ্চিত দিন-তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। কোরআনের সুস্পষ্ট বর্ণনা অনুযায়ী কোরআন নাজিল হয়েছে রমজান মাসের কদরের রাতে। অতএব, কোরআন অনুযায়ী কদরের রাত রমজান মাসের যে কোনো এক রাত। তাফসিরে মাজহারিতে নির্ভুল তথ্য এই যে, শবেকদর রমজান মাসের শেষাংশে আসে কিন্তু এর কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই, বরং যে কোনো বেজোড় রাতে হতে পারে? প্রত্যেক রমজানে তা পরিবর্তিত হয়।
‘রমজানের শেষ দশকের মধ্যে একটি বেজোড় রাত, ২১তম, ২৩তম ও ২৫তম রাতের অথবা ২৭তম ও ২৯তম রাতের মধ্যে একটি।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানের শেষ দিনের ‘বিজোড়’ রাতগুলোতে ‘লাইলাতুল কদর’ তালাশ কর।
মুহাম্মদ (সা.) রমজানের শেষাংশে ইতেকাফে বসতেন এবং তিনি রমজানের শেষ ১০ দিনে লাইলাতুল কদর খোঁজ করতেন। কদরের রাত প্রসঙ্গে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলীয়ে কামেল শামসুল ওলামা আল্লামা হজরত শাহ সুফি সৈয়্যেদ আহমদ আলী ওরফে হজরত শাহ্ সুফি সৈয়্যেদ জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী (রা.) স্বরচিত নূরেহক গঞ্জেনূর কিতাবে লিখেছেন-
‘রমজানে একুশ রাতে/তেইশা, পঁচিশা আর সাতাইশাতে পড়ে
ঊনত্রিশ তারিখেতে কদর আছয়/সাতাইশ তারিখ পরে এজমা সবে কয়।’
রমজানের ২৭ তারিখে লাইলাতুল কদর হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তবে বহুসংখ্যক প্রমাণ রয়েছে যে, ২৭ তারিখে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। এটি শুধু সম্ভাবনা হিসেবে গ্রহণ করা যায়, সুনিশ্চিত হিসেবে নয়।
হজরত বড়পীর মহিউদ্দিন আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) ‘গুণিয়াতুত ত্বালেবিন’ গ্রন্থে কদরের রাত নির্দিষ্ট না করার কারণ সম্পর্কে লিখেছেন, স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে যে, শুক্রবারের মতো কদরের রাতও আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিলেন না কেন? এর উত্তর হল, কেউ যেন নির্দিষ্ট দিনটিতে ইবাদত-বন্দেগি করে মনে না করে যে, আজকের রাতটি আমার হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমি আজকের ইবাদতের জন্য অবশ্যই জান্নাতবাসী হব। এরকম হলে তার পরবর্তী ইবাদতে ঘাটতি দেখা দেবে। তাই আল্লাহ এ রাতকে অনির্দিষ্ট করে রেখেছেন। ঠিক যেমন মানুষ কবে মারা যাবে তা আল্লাহ কাউকে জানতে দেন না। কারণ এরকম হলে লোকে ভাবত মৃত্যু তো এখনও দেরি আছে। এখন যা ইচ্ছা করি।
শেখ সাদী (র.) বলেছেন, ‘সকল রাত যদি শবেকদর হতো তাহলে থাকত না শবেকদরের মর্যাদা।’
সুতরাং সেই অনির্দিষ্ট রাতটি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সঠিক শবেকদর পেতে হলে যথাযথভাবে চান্দ্রমাসের হিসাব গণনা করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে যথাযথ প্রযুক্তিময় পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। তাই আমরা শবেকদরও পাই না। কদরে বর্ণিত রহমত-নেয়ামত তো দেশভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন চাঁদ দেখার তারিখে অবতীর্ণ হয় না। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা শবেকদরের মূল্যবান ফজিলত থেকে হয়তো বঞ্চিত থেকে যান। বিষয়টি সব মুসলমানকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি। কেননা, চাঁদের হিসাবে গড়মিল হলে আমাদের যাবতীয় হিসাবেই গড়মিল হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের শবেকদরের সঠিক হিসাব খোঁজ করার তৌফিক দিন।
No comments :
Post a Comment